নিরব কান্না || সুহার জীবনের গল্প


রাতের আকাশে একটা ফালি চাঁদ, তার ম্লান আলো মেখে বসে আছে বিশাল অন্ধকার। একপাশে হালকা বাতাসে দুলছে প্রাচীন গাছ, যেটার শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করেছে। আর সেই গাছের তলে বসে আছে নিঃশব্দে এক নারী। চোখে তার বিষণ্ণতা, মুখে নিরবতা—এই হলো সুহা। তার চারপাশে নিরবতা, শুধু মনের ভেতরটা ভাঙছে তীব্র কান্নায়।

সুহার জীবনের প্রতিটি দিনই যেন একটি নতুন যন্ত্রণার পর্ব। বিয়ের প্রথম দিকে সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার স্বামী রবিনের রূপ বদলাতে লাগল। একসময়কার ভালোবাসার মানুষটি আজ এক নিষ্ঠুর, নির্দয় পুরুষে পরিণত হয়েছে। রবিনের প্রতিটি কথায়, প্রতিটি আচরণে সুহা ধীরে ধীরে যেন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। 

প্রথম প্রথম রবিনের মানসিক নির্যাতন সহ্য করলেও, সুহা ভেবেছিল পরিস্থিতি হয়তো একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন দিন তা বাড়তে থাকল। ছোটখাটো বিষয়ে রবিনের অপমানজনক কথাগুলো তার হৃদয়কে আঘাত করতে লাগল। সে ক্রমশ বুঝতে পারল, এই সংসার তাকে মেনে নিতে চায় না। এমনকি তার শ্বশুর-শাশুড়িও রবিনের দোষগুলোকে ঢাকতে ব্যস্ত থাকেন। তারা তাকে বকাঝকা করেন, বলেন, "তুইই ঠিকভাবে সংসার করতে পারছিস না। রবিন যা করছে, তোর জন্যই করছে।"

সুহা সব সহ্য করে নীরবে দিন কাটায়। বাইরে থেকে দেখলে তাকে হাসিখুশি মনে হতে পারে, কিন্তু তার ভিতরটা কষ্টে ভেঙে পড়েছে। তার চোখে জল আসে না, কিন্তু মনের ভিতরটা কাঁদছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। তার কান্না বাইরে প্রকাশিত হয় না, কেবলমাত্র তার আত্মার গভীরে প্রতিধ্বনি হয়ে থাকে।

একদিন রবিনের রাগের বশে সুহাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে বসে। সেই রাতেই সুহা সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর এই নির্যাতন সহ্য করবে না। কিন্তু কোথায় যাবে সে? কীভাবে পারবে এই বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে? সুহা জানে না।

তবুও, সুহা তার নিরব কান্নাকে শক্তি বানিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে বাসা ছেড়ে চলে যায়। তার গন্তব্য অজানা, কিন্তু তার মনোভাব দৃঢ়। সুহা বুঝে গেছে, তার বেঁচে থাকার জন্য তাকে লড়াই করতে হবে, নিজের অধিকারের জন্য দাঁড়াতে হবে।

বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর সুহা এক অজানা শহরে পৌঁছায়। সেখানকার এক নির্জন কোণে সে আশ্রয় নেয়। এ শহরে কেউ তাকে চেনে না, তার কষ্টের কথা জানে না। এখানেই সে নতুন জীবন শুরু করে। একটা ছোট চাকরি করে নিজের খরচ চালাতে শুরু করে।

এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। সুহা তার নতুন জীবনে ধীরে ধীরে স্থিরতা আনতে থাকে। সে বুঝতে পারে, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে গেলে তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়ে না। তার নিরব কান্নাই তাকে প্রতিনিয়ত শক্তি যোগায়।

এদিকে, রবিন ও তার পরিবার সুহার অনুপস্থিতি টের পায়। তারা প্রথমে ভেবেছিল, সুহা হয়তো কিছুদিনের জন্য কোথাও চলে গেছে, আবার ফিরে আসবে। কিন্তু সময় গড়াতে থাকে, আর সুহার কোনো খবর না পেয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। 

রবিন অবশেষে বুঝতে পারে তার ভুল। সে সুহার উপর নির্যাতন করে তার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। সুহা ফিরে আসেনি, আর কখনোই ফিরে আসবে না। 

সুহা তার নতুন জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সে জানে, অতীতের কষ্টগুলো তাকে দুর্বল করেনি, বরং তাকে শক্ত করেছে। তার কান্না এখন আর নিরব নয়, বরং তার কান্না তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। 

এভাবেই সুহা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে লড়াই করে যাচ্ছে, আর সেই লড়াই তাকে শক্তিশালী করছে। তার নিরব কান্না আর কোনোদিনও থামবে না, কারণ সেই কান্নাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। 

এই গল্পটি শুধুমাত্র সুহার নয়, বরং সমস্ত নারীদের যারা নির্যাতনের শিকার হয়েও নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। সময় এসেছে সেই নিরব কান্নাকে শক্তিতে পরিণত করার, নিজেদের অধিকারের জন্য দাঁড়ানোর।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিশুর কান্না || ভুতের গল্প

প্রাচীন গাছের আড়ালে || ভুতের গল্প